আপনি বিদেশে যাবার জন্য অনেক আগে থেকে চিন্তা ভাবনা করছেন। ভাবছেন কোন দেশে গেলে ভালো হবে। কার মাধ্যমে যাবেন। তাকে কতো টাকা দেবেন, সে টাকা মেরে দেবে কিনা। আসলে এ সবই অমূলক ধারনা। আপনি যদি প্রকৃতপক্ষে বিদেশে যেতে চান তবে আপনাকে কমিটেড হতে হবে। আমি যখন ভিসা প্রসেসিং নিয়ে কারো সাথে কথা বলি বা কেউ কোন তথ্য জানার জন্য আমার কাছে ফোন দেন আমি বেশ মুষড়ে পড়ি তাদের কথা শুনে। বেশীরভাগ মানুষের সাথে আমার কথোপকথন হয় এমনঃ
-ভাই আমি ইউরোপে যেতে ইচ্ছুক। আমাকে ইউরোপে যেতে হবেই। আমি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যাবো।
আমি- পাসপোর্ট আছে?
- জ্বিনা, বানাবো ভাবছি।
আমি- এখনও পাসপোর্ট বানাননি কেন?
-পাসপোর্ট তো তেমন গুরুত্বপূর্ন নয়। ওটা পরে বানালেও চলবে। আগে তো কাগজপত্র বানাতে হবে।
আমি-ভালোই বলেছেন। তা আপনি কি পাস? মানে আপনার সর্বশেষ ডিগ্রী কি?
-আমি ভাই পড়াশোনা করিনি। যাবার সময় নীলক্ষেত থেকে একটা বানিয়ে নিলে চলবেনা? টাকা দিমু।
আমি-আপনি কি বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবেন? নাকি........
-আরে ভাই আপনে কি বাতাস খাইয়া বড়ো হইছেন? বুঝেন না? বিদেশে কি মানুষ পড়তে যায় নাকি টাকা কামাইতে যায়।
আমি-কিন্তু আপনি তো বললেন যে আপনি বিদেশে পড়তে যাবেন। আবার বললেন পড়াশোনাই করেন নাই। তাহলে সেখানে যাবেন কিভাবে?
-আরে ভাই আপনে তো দেখছি এই লাইনের কিছুই বোঝেননা। আরে টাকা দিলে কি না হয়। কতো ফার্ম বইসা আছে ভিসা প্রসেসিং করনের জন্য। টাকা দিমু কাম শেষ। আমারে এ্যামবাসিতে যাইতেও হইবোনা। থাক ভাই বুঝছি আমনে কি ভিসা প্রসেসিং করেন। এখন রাখি।
তার কথা শুনে শুধু আমি যে হতাশ তাতো নয়, আপনারাও নিশ্চয়ই হতাশ। এমন লোকের ভিসা পেপার প্রসেসিং করলে ভিসা যে রিফিউজড হবে তা নয়, ইজ্জত যাবারও সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে ৮০ ভাগ বিদেশযাত্রীই এমন ধরনের। এটা আমি বুঝেছি তাদের ফোন কল থেকে। দৈনিক আমাকে চল্লিশ পঞ্চাশটা ফোন কলে তথ্য দিতে হয়। যারা তথ্য চায় দেখা যায় তাদের বিদেশ যাবার প্রস্তুতি প্রায় শেষের পর্যায়ে। কিন্তু তাদের পাসপোর্ট তখনও করানো হয়নি। পাসপোর্ট যে খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় এটা তারা মানতে নারাজ। বাংলাদেশের বিদেশযাত্রীদেরকে আমি তিন ভাগে ভাগ করিঃ
১। চরম মুর্খ বিদেশযাত্রী যারা ভাবছে টাকা দিলেই সব কাজ হয়ে যাবে। তাদের নিজস্ব কোন কাগজপত্র নেই।
২। মধ্যমশ্রেনীর বিদেশযাত্রী। যাদের পাসপোর্ট আছে কিন্তু তারা ভাবছে তাদের ভিসা পাবার যথেষ্ঠ যোগ্যতা রয়েছে। বিদেশের ভিসা রিফিউজ হবার কারনই হলো এজেন্টের গাফিলতি।
৩। যোগ্য বিদেশযাত্রী। এদের পাসপোর্টে ভিসা আছে বেশ কয়েক দেশের।এরা জানে কি কি কাগজপত্র লাগে ও ভিসা পাওয়া ও রিফিউজ হবার কারনই যে এ্যামবাসি সেটার ব্যাপারেও মোটামুটি ধারনা আছে তাদের। এই শ্রেনীর কাস্টমাররা কেবল সার্ভিস চার্জ দিতে চায়। কোন ধরনের ফুল কন্ট্রাক্টে যেতে চায়না।
১ম ভাগের যাত্রীদের কারনেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও জনশক্তি বিভাগে এত বিপুল পরিমানে কারচুপি, অনিয়ম ও নানা ধরনের বিপত্তি ঘটে থাকে। এই ধরনের যাত্রীরা কিছুই বোঝেনা, যার কারনে তারা দালালের কাছে যায়।দালাল এদের অশিক্ষা ও অনভিজ্ঞতার সুজোগ নিয়ে থাকে। এইসব মুর্খ লোকদের নিয়ে তারা বডি কন্ট্রাক্ট বডি কন্ট্রাক্ট খেলাও খেলে থাকে। যার ফলাফল আমরা দেখতে পাই থাইল্যান্ড দিয়ে মালয়শিয়ায় ঢোকানোর নাম করে থাইল্যান্ডে এদের কবর দেয়ার ঘটনা। এর কারন হলো এরা কেবল বিদেশে যেতে চায়। কিভাবে যাচ্ছে সে ব্যপারে তাদের কোন ধারনা থাকেনা।যে দেশে যাচ্ছে সে দেশের আইন কানুন কি, চাকরি পাবে কিনা নাকি ইমিগ্রেশন ল’ এর কারনে জেলে যাবে সেটাও তাদের মাথায় থাকেনা। ২য় শ্রেনীর যাত্রীরাও এজেন্টদের অনেক ভোগান্তি সৃষ্টি করে থাকে। আমরা যারা ভিসা পেপার প্রসেসিং এ যুক্ত আছি তাদেরকে নানা ধরনের প্রশ্ন করে থাকে এরা, যে সমস্ত প্রশ্ন তারা করে যেগুলোর উত্তর তাদের জানা আছে কিন্তু তারা আমাদের মুখ থেকে শুনতে চায়। যেমন ভাই ভিসা হবেতো? ভাই এ্যামবাসির ভেতরের কেউ নেই যার সাথে কন্ট্রাক্ট করা যায়? যদি ভিসা না দেয় তাহলে আপনি কিন্তু ক্ষতিপুরন দেবেন আমাকে। আমার ভিসা যদি না হয় তাহলে ভাই আপনের অফিসের সব কিছু ভাইঙ্গা চুইরা ফালামু, আমার ভাই (অমুক তমুক) আছে, তারে কইয়া রাখছি.....। প্রথম ভাগের যাত্রীরা একটু গরীর ধরনের হয় বলে এরা বড়ো বড়ো কথা বলতে সাহস পায়না।
৩য় ভাগের যাত্রীদের সাথে কাজ করে আমি মজা পাই কারন এরা প্রকৃত বিদেশ যাত্রী। এদের ক্ষমতা থাকলেও প্রকাশ করেনা। এরা যুক্তিবাদী, পরিশ্রমী, প্রসেসিং কিছুটা হলেও বোঝে। দরকারী কাগজপত্র এরা আগেভাগেই জোগাড় করে রাখে ফলে যাবার আগে ঝামেলা পোহাতে হয়না। কিছুদিন আগেও আমেরিকার যাবার জন্য এক দম্পতি এসেছিল আমার কাছে। মোট চারটা দেশের ভিসা ছিলো তাদের দু’জনার পাসপোর্টে। তাদের সব কাগজপত্র ছিলো। ইচ্ছা করলে তারা নিজেরাই ফর্ম ফিলআপ করে ভিসার জন্য এ্যামবাসিতে দাঁড়াতে পারতো কিন্তু তারা আমার শরনাপন্ন হয়েছিলো। একথা বলতে তারা নিজেরাই বললো, ‘ভাই দেখুন, রাজমিস্ত্রী যে কাজ করে সে কাজ আমরাও বুঝি, ইঁটের ভেতর সিমেন্ট বালুর আস্তর দিয়ে আরেকটা ইঁট বসায়। আমরা ইচ্ছে করলে তাদের কাজটা করতেও পারি। কিন্তু কাজটা আমি যদি করি তাহলে কি রাজমিস্ত্রীর মতো পাকাপোক্ত হবে? চমৎকার যুক্তি। আমার খুব ভালোলেগেছিলো। তাদের কাজ করলাম। ভাগ্য বেশ ভালো তাদের। ভিসা হয়ে গেল। ভিসা হয়ে যাবার পরই তারা আমার সার্ভিস চার্জ দিয়ে দিল। তাদের সাথে এখনও ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আমার। আমেরিকায় যাবার আগে আমি আমার নিজের বাড়িতে ইনভাইট করে তাদের দুপুরের লাঞ্চ করিয়েছি। এ ধরনের সম্পর্ক আসলে এই লাইনে বিরল কারন এজেন্ট কাজ করে লাভের জন্য। ক্লায়েন্ট কাজ করে ভিসার জন্য। এজেন্ট নিজের লাভের দিকে তাকিয়েই কাজটা সুচারূভাবে সম্পন্ন করতে চায়। তাই ক্লায়েন্ট যখন বারবার বলে-ভাই ঠিকঠাকমতো সব কিছু করবেন যেন ভিসা হয়, তখন নিতান্তই বিরক্ত লাগে। ১ম ও ২য় ধরনের যাত্রীরা আরেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে ওস্তাদ। সেটা হলো,‘ভাই ভিসা হলো কিন্তু এয়ারপোর্ট দিয়ে যদি ঢুকতে না দেয়? এ ধরনের সমস্যা যাতে না হয় তাই তাদের সাথে আমি ‘ভিসা কন্ট্রাক্ট’ করেই নেই, কিন্তু ভিসা হবার পর তারা এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। কয়েকটা দেশে ভিসা হয়ে যাবার পর সে দেশের ইমিগ্রেশনে কোন সমস্যা হয়না। দেশগুলো হলোঃ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানী, রাশিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মালয়শিয়া (স্টুডেন্ট, জব ও ইনভাইটেশনে ভিজিট), সিঙ্গাপুর (স্টুডেন্ট, জব ও ইনভাইটেশনে ভিজিট)। তাই এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন করা থেকে এজেন্টদের রেহাই দিন। আরো কিছু ব্যপার খেয়াল রাখবেন। আমরা বাংলাদেশীরা কিন্তু বিদেশে গিয়ে দেশ সম্পর্কে ভালো কোন ইমপ্রেশন দিতে পারিনা। আমাদের পোশাক আশাক, চলাফেরা, আচরন দিয়ে আমরা বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করি যখন বিদেশীরা আমাদেরকে নিচু চোখেই দেখে থাকে। তাই বিদেশে যাবার আগে নিজেকে যোগ্যভাবে গড়ে তুলুন। নিজের সব পেপার বহু আগে থেকেই সংরক্ষন করুন। ভাবুন আপনাকে ভিসা দিয়ে সেই দেশের কি লাভ হবে। ভিসা অফিসারের সাথে ন্যুনতম কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকুন। ভিসা কেউ কাউকে দেয়না, নিজেকে অর্জন করে নিতে হয়। তাই আপনার পাসপোর্ট আগে বানান, আপনার এনআইডি হাতের কাছে রাখুন, অনলাইন বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে রাখুন, আজই একটি অনলাইন ব্যাংকে একটি কোম্পানী আইডি দিয়ে কারেন্ট এ্যাকাউন্ট ও নিজের আইডি দিয়ে সেভিংস এ্যাকাউন্ট খুলুন এবং প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার ট্রানজেকশন করুন। কোট ও টাই পরিহিত অবস্থায় পাসপোর্ট সাইজের নিজের ছবি তুলে রাখুন ভালো কোন স্টুডিও থেকে। মনে রাখবেন আপনার এমআরপি বা ডিজিটাল পাসপোর্টের এককোনে একটি ‘পি’ অক্ষর ছাড়া আপনার পেশাগত কোন তথ্য থাকেনা। আপনার পেশা যদি প্রাইভেট সার্ভিসও হয়ে থাকে ও ফর্ম ফিলআপের সময়ে যদি তা দিয়ে থাকেন এবং অন্য দেশের ভিসা ফর্মে যদি বিজনেস দেখিয়েও থাকেন কোন সমস্যা নেই। অন্য দেশের এ্যামবাসি কখনও পাসপোর্ট দেখে পাসপোর্টের ফর্মে কি লিখেছিলেন তা জানতে পারবেনা। তাই এ নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
অনলাইন ব্যাংক এ কোম্পানি আইডি দিয়ে একটা কারেন্ট একাউন্ট মানে বুঝলাম না ভাই,
ReplyDeleteভাই আপনি যদি এই পেশায় না থাকেন কিভাবে বুঝবেন? যে কোন অনলাইন ব্যাংকে একটা কোম্পামী এ্যাকাউন্ট খোলার কথা বলা হয়েছে।
ReplyDelete