সোলাইমান নোয়াখালীর ছেলে। চর অজ্ঞলে তার জন্ম। বিদেশ কি চোখে দেখেনি, কেবল মানুষের কাছে শুনেছে যে বিদেশ গেলে টাকা (টিয়া) কামানো যায়। তার বিদেশ যাবার মতো টাকা নেই। আছে কেবল কিছু জমি। রিফাত নামে এক দালাল তাকে ব্রাজিলের স্বপ্ন দেখায়। দালাল বলে কিছু জমি বিক্রি করলেই তো তার যাবার টাকা উঠে যাবে। ব্রাজিল গেলে সে ওখান থেকে সুড়ুত করে আমেরিকা ঢুকতে পারবে। আর আমেরিকা গেলে তো কামাবে কাাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সোলাইমানের মা নিষেধ করে। সোলাইমান শোনে না। মায়ের সাথে কিছুদিন তর্ক বিতর্কের পর কয়েকটা জমি সে বিক্রি করে দেয়। আট লাখ টাকা পায়। আরও দুই লাখ টাকা দরকার। মামার কাছ থেকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে দুই লাখ টাকা ধার নেয় সোলাইমান। কিছু টাকা সে দালালের হাতে তুলে দেয়। দালাল তার পাসপোর্ট বানায়। সেই পাসপোর্ট আর কিছু কাগজপত্র যোগাড় করে তাকে নিয়ে আসে ঢাকায়। দালাল কোন এক এজেন্সির মাধ্যমে তার পাসপোর্ট জমা দেয় এ্যামবাসিতে। একুশ দিনের মাথায় সে ভিসা পায় ব্রাজিলের। সমস্ত টাকা তুলে দেয় সে দালালের হাতে। কিন্তু ব্রাজিল যে যাবে সেই ভাড়াও নেই তার কাছে। যাইহোক, অনেক কষ্টে সে ভাড়া জোগাড় করে। ব্রাজিলে চলেও যায় সে সময়মত। দালাল কিছু লোকের ঠিকানা দিয়েছিল। সোলাইমান বুদ্ধি করে তাদের সাথে দেখা না করে কিছু কাজ যোগাড় করে নেয়। মোটামুটি সত্তর হাজার টাকার মতো মাসে পাবে। কাজ করতে হবে একটা জুতোর দোকানে। সোলাইমান সেখানে প্রায় তিন মাস চাকরি করে। ব্রাজিলে সে যদি সঠিকভাবে থাকতো তবে আজ বেশ ভালোই থাকতে পারতো কারন ব্রাজিলে মোটামুটি ভালো বেতনই পাওয়া যায় আপনি যদি পর্তূগিজ ভাষা জানেন। সোলাইমান কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই ভাষাটার অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু বাধ সাধলো তার লোভ। তার সাথে একদিন দেখা হয়ে গেল জাবিরের। জাবিরও একটা দালাল। সে বললো সোলাইমান একটা বোকা। সে এখানে পড়ে না থেকে যদি আমেরিকায় যায় তবে মাসে সে আয় করতে পারবে তিন লাখ টাকা। আর আমেরিকা যেতে খরচ হবে তিন লাখ টাকা। ততদিনে চার মাস কেটে গেছে। সোলাইমান দুই লাখ টাকা জমিয়েছে। কিন্তু তার লোভ বলছে তাকে আরও বড়ো হতে হবে। জীবনে যতো রিস্ক আসুক তাকে তুচ্ছ করে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তার সহকর্মী মতিনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার নিল সোলাইমান। আবারও কিছু টাকা তুলে দিল দালালের হাতে। ব্যস, শুরু হলো তার নরকমুখী যাত্রা। ছয়জন দালালের একটা দল তার মতো আরও চারজন লোককে সাথে নিয়ে বেশ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তাদের নিয়ে গেল পেরু। ইচ্ছে করলে তারা সোজা পথে কলম্বিয়া ঢুকতে পারতো। তা না করে তারা পেরুর ভয়ানক পথ অতিক্রম করতে থাকলো। দক্ষিন আমেরিকার পেরুই সবচেয়ে দুর্গম এবং পশ্চাদপদ এক দেশ। এই পেরুর জঙ্গলই আমাজন জঙ্গল নামে পরিচিত যার বেশীরভাগ পেরুতে, ইকুয়েডরে আর কলম্বিয়ায় পড়েছে। এখানে দেখা মেলে নরখাদক জংলীদের। অনেক অভিযাত্রী এই পথে গিয়ে এসব নরখাদকদের পাল্লায় পড়ে তাদের খাবারে পরিনত হয়েছে। তাদের হাড়গোড়ও দেখতে পায় সোলাইমানের দল। ব্রাজিল থেকে যাত্রা শুরু করার আট দিন হয়ে গেছে তারা পেরুর জঙ্গল পার হতেই পারছেনা। কারন এর মধ্যে দুইজন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। দালাল দলের কাছে কিছু ওষুধপত্র থাকলেও এই জ্বরের কুইনাইন ছিলনা। তিন দিনের মাথায় আকবর আর কমর পেরুর জঙ্গলের ভেতর মারা যায়। সোলাইমান আর মজিব দু’জন দালাল দলের সাথে রওনা হয় ইকুয়েডর এর পথে। যাবার আগে জঙ্গলের ভেতর দু’জনের মৃতদেহ পুতে দিয়ে যায়। আমাজন বনে দেখা মেলে পৃথিবীর ভয়ংকর সাপ এ্যানাকন্ডা। এই সব সাপদের কোনটা প্রায় দশ গজ লম্বা। একটা মানুষকে গিলে খাওয়া কোন ব্যপারই নয় এদের জন্য। তের দিনের মাথায় তারা ইকুয়েডরে ঢুকতে পারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সোলাইমানের পা তখন কোন কারনে অবশ। আর মজিব কোন অজানা রোগে আক্রান্ত। তার ডাক্তার দেখাতে চায় কিন্তু দালালরা নারাজ। ডাক্তার দেখাতে গেলে পুলিশ ধরতে পারে তাদের। তাই একটু সুস্থ হতেই আবার শুরু হয় যাত্রা। আরও চারদিন অতিবাহিত হবার পর হঠাত তারা এক ডাকাত দলের মুখে পড়ে যায়। শুধু তাদের নয় দালালদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনও কেড়ে নিয়ে যায় তারা, ছিনিয়ে নেয় টাকা পয়সা। ছিনিয়ে নেয়া হয় খাদ্য, পানীয়। শুরু হয়ে যায় তাদের অসীম কষ্টের জীবন। সোলাইমান একবার ভাবে সে এদের কাছ থেকে পালিয়ে ইকুয়েডর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করবে, তারপর ফিরে যাবে ব্রাজিলে। কিন্তু সে জানেনা কোন পথে শহরে যাবে। এতো বনের সমুদ্র!
না খাওয়া, না দাওয়া। শুধা চলা আর থেমে পড়ে ব্যাগের ভেতর পড়ে থাকা বনের ভেতর থেকে পেড়ে আনা নাম না জানা ফল খাওয়া। একুশ দিন পর ইকুয়েডরের জীবন শেষ হয়। তারা কলম্বিয়ার বনে ঢুকে পড়ে। এখানে বন অগভীর। তাদের চলা স্বাভাবিক পথে, কিন্তু ততদিনে ঝিমিয়ে পড়েছে সকলে। এমন দিন গেছে যখন গাছের পাতা আর গুল্ম চিবুতে হয়েছে তাদের। এখানে একটা শহরে থেমে পর্তুগিজ ভাষায় ভিক্ষা চায় ওরা, খাবার চায়। খাবার পায়। খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এর মধ্যে মজিব হঠাত মারা যায়। কি রোগ বোঝা যায়না। দীর্ঘ এক মাস পর তারা পানামা খালের তীরে উপস্থিত হয়। ভিক্ষা করে কিছু টাকা আয় করেছিল তারা। সেই টাকা দিয়ে পানামা পার হয় তারা। ঢোকে কোস্টারিকায়। পৃথিবীর সৌন্দর্য্যময় এক দেশ, কিন্তু তাদের তখন চোখ নেই সেই দৃশ্য দেখার। শরীরের সব শক্তি এক করে রাখে তারা নিকারাগুয়ায় ঢোকার জন্য। একটা একটা দিন পার হয় আর পানির প্রতিচ্ছবিতে নিজের চেহারা দেখে চমকে ওঠে সোলাইমান। নিজের চেহারা নিজেই চিনতে পারেনা সে।
ব্রাজিল থেকে বেরুনোর এক মাস দশ দিন পর নিকারাগুয়ায় ঢোকে তারা। এখানে এসে দালালদের দ্বিতীয় দলের সাথে সাক্ষাত হয় তাদের। এই দালালদের সাথে আর চারজন্য লোক ছিল। এরাও সোলাইমানদের মতো মেস্কিকো যাবার পথিক। মোট বারো জন্য রওয়ানা দেয় নিকারাগুয়ার গ্রামের পথ ধরে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেও দালালদল তাদের বিশ্রাম দেয়না তাদের। একমাস চোদ্দ দিনের মাথায় তার পৌছায় হন্ডুরাসে। এখানে দালালচক্র তাদের বসিয়ে রাখে প্রায় এক সপ্তাহ। কোন এক নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে তারা। একদিন নির্দেশ আসে ফোনে। রওয়ানা হয় তারা হন্ডুরাসের ভেতর দিয়ে। পথে আবার অপেক্ষা। হন্ডুরাসের পুলিশ বাহিনীর ভয়ে যাত্রা বিরতি। অবশেষে একমাস তেইশ দিনে গুয়েতেমালা ঢোকে দালাল দল আর সাথে সোলাইমান। তারপর বেশ স্বাভাবিকভাবেই মেক্সিকো। কিন্তু ততদিনে শরীর ভেঙে গেছে সোলাইমানের। খাওয়া না খাওয়ায় চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। মনে হচ্ছে এক জীবন্ত কঙকাল হেঁটে যাচ্ছে পথ দিয়ে। কোন টাকা নেই, মোবাইল নেই, খাবার নেই, পানি নেই। কেউ দয়া করে দিলে খায় আর নাহলে উপোস।
মেক্সিকোর টুকসলা গুটিরেজ থেকে আমেরিকার বর্ডার অনেক পথ। পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে তবে তা পনেরো দিনের পথ। বিমানে যে যাবে টাকা কোথায়? দালালরা তাকে আটকে রাখে। অন্যদের ছেড়ে দেয়। তারা সকলেই বিমানের টিকিট কেটে আমেরিকার বর্ডার পর্যন্ত চলে যায়। অন্যপ্রান্তে আটক থাকে সোলাইমান। বহু অনুরোধ করে অবশেষে ছাড়া পায়। তার সাথে আসা দালালই অন্য গ্রুপের দালালদের কাছে নিজেদের দুর্দশার কথা বলে সোলাইমানকে ছাড়িয়ে নেয়।
শুরু হয় সোলাইমানের ভিক্ষুকের জীবন। ভিক্ষা করে আর একটু একটু করে আমেরিকার বর্ডারের দিকে যেতে থাকে। ভিক্ষা করে সে গাড়িভাড়া জোগাড় করে। বাইশদিন পর সে জুয়ারেজে পৌছায়। ওপাশে আমেরিকার এলপাসো। কিন্তু বর্ডারে ভীষন কড়া প্রহরা। কিভাবে ঢুকবে সে এতো ভয়ংকর কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে। তারপরও সে কিছু ভবঘুরের সাহায্যে বেড়া পার হয় সে। মরুভুমি পথ পাড়ি দিয়ে ওয়েস্টার্ন আমেরিকার এলপাসোতে আসে। তারপর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পথে পুলিশ তাকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার করে শহরে নিয়ে আসে। সোলাইমান কিছুটা সুস্থ হলেও বন্দী জীবন যাপন করতে থাকে। তারমনে শান্তি যে সে যেমনই থাকুক আমেরিকায় আছে। এখানে মরলেও সুখ। এখানে মরলেও শান্তি।
সে যাই হোক, ব্রাজিলে যেতে পারেন। সেখানে লাইফ আছে। তবে কোন দালালের পাল্লায় পড়ে আমেরিকার পথে রওয়ানা দেবেন না যেন পায়ে হাঁটা পথে। তাহলে সোলাইমানের মতো পরিনতি আপনার নাও হতে পারে। হয়ত: মজিব, আকবর বা কমরের মতো আপনার মৃতদেহ পড়ে থাকবে আমাজন বনের মাটির নিচে!
................ভিসাসফরইউ টিমের কাছে বর্নিত একজনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
0 Reviews:
Post a Comment